ফিচার- বন্যায় আটকে পরা ‘ঢাবি শিক্ষার্থীদের’ বেঁচে ফেরার গল্প!
প্রবল স্রোতের বিপরীতে সুরমা নদীর বুক চিরে আমাদের লঞ্চটি খুব ধীরে এগিয়ে যাচ্ছিল। বাইরে ভীষণ বৃষ্টি, ঘুটঘুটে অন্ধকার। একটি পুরোনো টর্চ আর মাঝেমধ্যে এর–ওর মুঠোফোনের ফ্ল্যাশলাইট ছাড়া আর কোনো আলো নেই সেখানে। লঞ্চের ধারণক্ষমতা ৪০ জন। সেই লঞ্চে আমরা ১০০ জনের বেশি। যাত্রা শুরুর ছয় ঘণ্টার মাথায় রাত আটটার দিকে কিছু একটাতে প্রচণ্ড জোরে ধাক্কা খেয়ে কাত হয়ে যায় আমাদের লঞ্চটি। মুহূর্তের মধ্যে নেমে আসে শরীর ঠান্ডা হয়ে আসা আতঙ্ক।
চলতে থাকে আর্তনাদ আর কান্নার শব্দ। এর মধ্যে জোরালো কণ্ঠে ভেসে আসে—কেউ নড়বেন না, মাঝে আসেন সবাই, এক লাইনে আসেন। আমি একেবারে নিশ্চুপ হয়ে যাই। শরীর কাঁপছিল খুব। ট্রমার চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গেছি। লঞ্চডুবির খবরে সব সময় আমরা মৃত্যুর সংখ্যা গুনি। আমার ভাবনায় কেবল আসছিল, এই দুর্গম আর নির্মম জলরাশির মাঝখানে এমন সংখ্যাতেই কি আমি ও আমার বন্ধুদের জীবন শেষ হয়ে যাবে?’
কথাগুলো বলছিলেন তাহসীন নাওয়ার প্রাচী। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী। সম্প্রতি সুনামগঞ্জের হাওরে বন্ধুদের সঙ্গে ভ্রমণে গিয়ে ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়েছিলেন তিনি। গত বৃহস্পতিবার রাতে তাঁদের ২১ জনের দলটির ঢাকায় ফেরার কথা ছিল। তবে দীর্ঘ বিপদের পথ পেরিয়ে রোববার দিবাগত রাত সাড়ে ১২টার দিকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একটি দল তাঁদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এনে নামিয়ে দেয়। সেখানে অভিভাবক ও সহপাঠীরা তাঁদের বুকে জড়িয়ে নেন।
শিক্ষার্থীদের সেখান থেকে নিরাপদে ফিরিয়ে আনতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, সেনাবাহিনীর সদর দপ্তর, সিলেটের ডিআইজি, সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপারসহ বিভিন্ন পর্যায়ে যোগাযোগ করে। শনিবার বেলা দুইটার দিকে তাঁরাসহ আটকে পড়া আরও শ খানেক মানুষকে সুনামগঞ্জ থেকে সিলেটে পাঠানোর জন্য একটি লঞ্চে তুলে দেয় পুলিশ। ধারণক্ষমতার দ্বিগুণের বেশি যাত্রী তোলা হয়েছিল লঞ্চটিতে। স্রোতের বিপরীতে আসায় লঞ্চ বেশ ধীরগতিতে চলছিল। পথে লঞ্চের দুটি ইঞ্জিন বিকল হয়ে যায়, কোনোভাবে বাকি একটি ইঞ্জিন দিয়ে লঞ্চ এগোচ্ছিল। এর মধ্যে রাত আটটার দিকে দোয়ারাবাজার উপজেলা সদরের কাছাকাছি পৌঁছালে সুরমা নদীর ইউলুপে একটি ডুবো বাঁধে ধাক্কা খেয়ে একদিকে কাত হয়ে সেখানেই আটকে যায় লঞ্চটি।
এভাবে বাঁধে আটকা পড়ে সেখানে প্রায় ছয় ঘণ্টা অপেক্ষা করেন তাঁরা। এদিকে বৃষ্টি কিংবা স্রোত কোনোটাই কমছিল না। লঞ্চের তলায় বাঁধের মাটি ক্ষয়ে ক্ষয়ে সেটি সামনের দিকে একটু একটু করে ডুবছিল।
আরও পড়ুন: মানবতার অন্যতম দৃষ্টান্ত ফ্রী মোশন’র ফিরোজ
রোববার ভোর সাড়ে চারটার দিকে ছাতকের কাছাকাছি একটি ফেরিঘাটে লঞ্চটি নোঙর করে। তখন সেনা সদরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন তাঁরা। শিক্ষার্থীদের ওই ঘাটেই অবস্থান করতে বলা হয়। তবে লঞ্চের যাত্রীদের একটি অংশ এগিয়ে যেতে চান।
সে জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষার্থীরাসহ আরও বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী লঞ্চ থেকে ঘাটে নেমে অপেক্ষা করেন। সকাল আটটার দিকে সেনাবাহিনীর পাঁচটি স্পিডবোট সেখান থেকে তাঁদের উদ্ধার করে গোবিন্দগঞ্জ অস্থায়ী ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সেখানে তিন দিন পর তাঁরা ভাত খেতে পান। এরপর তাঁদের নেওয়া হয় সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে দেখা করে কথা বলেন। বিকেলের দিকে তাঁদের সেনাবাহিনীর নিজস্ব মিনিবাসে ঢাকার উদ্দেশে পাঠানো হয়।
রাত সাড়ে ১২টার দিকে তাঁদের বহনকারী গাড়িটি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকায় এসে থামে, তখন উল্লাসে ফেটে পড়েন তাঁদের স্বজন ও সহপাঠীরা। বুকে জড়িয়ে নেন তাঁদের। শোয়াইব আহমেদ বলেন, ‘আমরা যে সবার সঙ্গে আবার দেখা করতে পারব, সেটা ভাবতেই পারিনি। বেঁচে আছি, এটা ভেবেই আনন্দে কাঁদছি বারবার।’
ইচ্ছাব্লগ ডট কম/এম.এম
COMMENTS