প্রতিদিনের মতোই রাত ন'টায় আমার অফিস ছুটি। আজ সকাল থেকেই ভাবছিলাম অফিস থেকে তাড়াতাড়ি বের হয়ে বন্ধু হিমেলের সাথে দেখা করব। সে নাকি মিরপু...
প্রতিদিনের মতোই রাত ন'টায় আমার অফিস ছুটি। আজ সকাল থেকেই ভাবছিলাম অফিস থেকে তাড়াতাড়ি বের হয়ে বন্ধু হিমেলের সাথে দেখা করব। সে নাকি মিরপুরে তার খালার বাসায় বেড়াতে এসেছে। সেই ছ'মাস থেকে তার দেখা নেই। অনেক দিনের জমিয়ে রাখা কথা গুলো বলে একটু হালকা হবো। তাই সকাল থেকে মনটা ভীষণ ছটফট করছে। কখন দেখা হবে তার সাথে। সময় যেন কাটছেই না।
ঘড়িতে তখন রাত ৮ টা ৫০ মিনিট। আহ! একটু পরেই বের হবো বন্ধুর উদ্দেশ্যে। ঠিক এমন সময় বস, মাহিদ সাহেব? বললাম, জ্বি ভাইয়া! বস, ভোলা আর যশোর থেকে কিছু মেইল এসেছে। সাফিন সাহেবের আজ 'ডে অফ' তাই মেইল গুলোর কাজ আপনাকে দেখতে হবে। তখন, বসের কথা গুলো শুনে প্রচন্ড রাগ হচ্ছিলো। ব্যাটা! আমাকেই চোখে পড়লো। রাগ, ক্ষোভ আর বিরক্তি নিয়ে একটা ফ্যাকাসে হাসি দিয়ে বললাম জ্বি ভাইয়া করছি তাহলে। মেজাজ স্বাভাবিক করে আবারো কাজে মনযোগ দেয়ার চেষ্টা করলাম। কাজ শেষে ঘড়ির দিকে তাকাতেই চমকে উঠলাম! তখন ১১ টা ৫০ মিনিট। ঠিক ১২ টায় গেইটে তালা ঝুলিয়ে দেয় বাড়িওয়ালা। দ্রুত কম্পিউটার বন্ধ করে বাইরে এসে একটি বাসে উঠলাম।
বাসার গেইট পর্যন্ত আসতে আসতে ১২টা ৩০ মিনিট। ততক্ষণে তালা ঝুলছিলো গেইটে। সাথে সাথে রুমমেট আর বাড়িওয়ালাকে ফোন করলাম। কাকতালীয়ভাবে সবার নম্বর বন্ধ পেলাম। বেশ কিছুক্ষণ ডাকাডাকি করেও কোনো কাজ হলো না। শেষমেশ নিরুপায় হয়ে সিদ্ধান্ত নিলাম রাতটি বাইরে কাটানোর। গেইটের সামনে থেকে হাটতে হাটতে রাস্তায় চলে এলাম। দেখলাম, রাস্তার পাশে ফুটপাতে অনেকেই শুয়ে আছে। হঠাৎ এক শিশুর চিৎকার! লক্ষ্য করলাম থেমে থেমে কান্না করছে শিশুটি। কাছে গিয়ে তার কান্নার কারণ জানতে চাইলাম । কিছুতেই তার কান্না থামছে না। শিশুটির বয়স আনুমানিক সাত বছর। ঘন কুয়াশা আর তীব্র শীতে পুরো শরীর শীতল হয়েছে শিশুটির। তখন আমার শরীরে থাকা চাদরটি তাকে জড়িয়ে দিলাম। মাটিতে বিছিয়ে রাখা তার বস্তায় বসতে চাওয়ায় কাপা কাপা গলায় শিশুটি বলে উঠলো বহেন! কিছুক্ষণ পর শিশুটি আমাকে বললো, “ঠান্ডা বাড়ছে, খুব শীত করতাছে মনে হয় আইজকা মইরা যামু"।
আমি তাকে সান্তনা দিয়ে তার সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলাম। সে ধীরে ধীরে তার সম্পর্কে বলতে শুরু করল, রাজধানীর পল্লবীর এক বস্তিতে তার বাসা। তার নাম সোহান মিয়া। বছরখানেক আগে সড়ক দুর্ঘটনায় তার বাবা মারা যায়। পরে তার মায়ের নতুন জায়গায় বিয়ে হলে তার সৎ বাবা তাকে মারধর করে বাড়ি থেকে বের করে দেয়। সেদিন থেকেই রাস্তায় থাকে সোহান। কনকনে শীত আর মশার কামড়ে এভাবেই রাস্তায় পড়ে থাকে সে। সকালে উঠে ডাস্টবিন থেকে খাবার খাওয়া আর কাগজ কুড়ানোই এখন তার নিত্যদিনের কাজ। মাঝে মাঝে ৩-৪ দিনও না খেয়ে থাকে সোহান। অথচ বড় হয়ে ডাক্তার হয়ে মানুষের সেবা করতে চেয়েছিলো সোহান।
তখন চোখের সামনে ভেসে উঠলো দেশের পথ শিশুর পরিসংখ্যান। এক হিসাবমতে, দেশে বর্তমানে প্রায় ১১ লাখ পথশিশু রয়েছে, যার প্রায় অর্ধেকেরই বাস রাজধানী ঢাকায়। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) হিসাবমতে, শুধু ঢাকা শহরে প্রায় চার লাখ ৫০ হাজার পথশিশু রয়েছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো দেশটির সর্বশেষ আদমশুমারিতে ভাসমান মানুষ সম্পর্কে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে বলছে, দেশটিতে চার লাখের মতো পথশিশু রয়েছে, যার অর্ধেকই অবস্থান করছে রাজধানী ঢাকায়। অন্যদিকে জাতিসংঘের শিশু তহবিল ইউনিসেফ বলছে, বাংলাদেশে পথশিশুর সংখ্যা ১০ লাখের বেশি। ঢাকার হিসাব অবশ্য তাদের কাছে নেই। বার্তা সংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শুধু ঢাকাতেই ছয় লাখ পথশিশু রয়েছে। সারা দেশে পথশিশুর সংখ্যা ১০ লাখ।
এসব ভাবতে ভাবতে কানে ভেসে এলো মুয়াজ্জিনের আজানের ধ্বনি। তীব্র ঠান্ডা আর কুয়াশায় আমার শরীর তখন প্রায় ভিজে গেছে। কাঁপতে কাঁপতে মসজিদে গেলাম সালাত আদায় করতে। দোয়া করলাম সোহানসহ সকল পথশিশুদের জন্য। এভাবেই শত সোহানের ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন কালের অতল গহ্বরে হারিয়ে যাচ্ছে। আর ততক্ষণে সোহান চলে গেছে শীতল ঘুমে।
ইচ্ছাব্লগ ডট কম/এম.এম
COMMENTS