কোন ব্যক্তিদের নামের পূর্বে মাওলানা শব্দ ব্যবহার করতে হয়? অনেকেই বলে থাকেন- ‘মাওলানা’ শব্দটা মানুষের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা ঠিক না। ওই সকল ব্যক্তিদের ব্
কোন ব্যক্তিদের নামের পূর্বে মাওলানা শব্দ ব্যবহার করতে হয়?
অনেকেই বলে থাকেন- ‘মাওলানা’ শব্দটা মানুষের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা ঠিক না। ওই সকল ব্যক্তিদের ব্যাখ্যা হলো- কোরআনে ‘মাওলানা’ বলতে আল্লাহ্-কে বোঝানো হয়েছে। নিম্নে বিষয়টির ব্যাখ্যা উপস্থাপন করা হলোঃ-
রাব্বুন শব্দের অর্থঃ প্রতিপালক, রাব্বানা অর্থ আমাদের প্রতিপালক। (রব্ব+না) =রাব্বানা। [জুমা মুতাকাল্লিমের ছিগা] অনুরূপ ভাবে মাওলা শব্দের অর্থ অভিভাবক, সাহায্যকারী, বন্ধু ইত্যাদি। মাওলা ওলী শব্দের ভিন্নরূপ। যার বহুবচন আউলিয়া এবং মুতাকাল্লিমের ছিগা হলো মাওলানা। যার অর্থ "আমাদের বন্ধু"।অনেকে নাহু ছরফ না জেনে মাওলা + আনা =মাওলানা বলে থাকেন। বাংলার মত আরবীকে সন্ধি বিচ্ছেদ করলে চলবেনা। মাওলা এর সাথে 'না' যোগ হয়ে আমাদের মাওলা বুঝাচ্ছে। মাওলা + আনা = মাওলানা অর্থাৎ আমি মাওলা কখনোই হবেনা এটি ভুল। যে ভাবে রাব্বানা ঠিক সে ভাবেই মাওলানা। (রাব্ব + না = রাব্বানা) (মাওলা + না = মাওলানা) এখানে মাওলা + আনা কোন ভাবেই হওয়ার কথা নয়। আরবী না জানা লোকেরাই এই ভাবে সন্ধি বিচ্ছেদ করেছে।
দেখুন [সুরা আরাফের ২৩ নং আয়াতে] রাব্বানার পরে যালামনা, আনফুসানা, ওয়াইল্লামতাগ্বফির লানা, ওতারহামনা লানাকুনান্না মিনাল খাছিরীন। এই " না" দ্বারা "আমরা" "আমাদের" বুঝানো হয়েছে।
‘মাওলানা’ টাইটেলটা বিশেষত মধ্য-এশিয়া এবং ভারতীয় উপমহাদেশেই ব্যবহৃত হয়ে থাকে। ‘মাওলানা’ শব্দটি আরবী, তবে আরব থেকে ইরান, তুর্কি, আফ্রিকা এবং ভারত উপমহাদেশ ঘুরে নানান অর্থ পরিগ্রহ করেছে। যেমন- পারস্যের (ইরানের) প্রখ্যাত কবি রুমি’র নামের আগে আমরা ‘মওলানা’ ব্যবহৃত হতে দেখি। ‘মাওলানা’ শব্দটির তুর্কি উচ্চারণ হলো- ‘মেভলানা’। আফ্রিকার ‘শোয়াহিলি’ ভাষায় (Swahili language) এই শব্দটি কৃতঋণ হিসেবে কোনো সম্প্রদায়ের, ধর্মের সম্মানিত নেতার নামের আগে টাইটেল হিসেবে ইংরেজী ‘স্যার’-এর মতো ব্যবহৃত হয়ে থাকে। পশ্চিম আফ্রিকার মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলের ‘হাউসা’ ভাষায় (Hausa language) ‘মাল্লাম’ এবং ‘উলুফ’ ভাষার (Wolof language) ‘মাম্মে’ শব্দটি এসকল ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়। ‘হাউসা’ ভাষার ‘মাল্লাম’ শব্দটি ইংরেজী শব্দের ‘মিস্টার’-এর সমার্থক। ‘হাউসা’ ভাষার ‘মাল্লাম’, শোয়হালি ভাষার ‘মুয়ালিমু’, আরবী ভাষার ‘মু’আল্লিম’ আর মরোক্কীয় আরবীর ‘মা’আল্লাম’ শব্দটির ইংরেজী অর্থ হয় মাস্টার কিংবা টিচার।
‘মাওলানা’ শব্দটি মুসলিম ধর্মীয় পন্ডিতের ক্ষেত্রে শ্রদ্ধাপূর্ণ অর্থবহন করে, অপরদিকে যেমন ‘মোল্লা’ শব্দটি অবমাননাকর অর্থবহন করে সেই সকল ব্যক্তিবর্গের ক্ষেত্রে যাদের মধ্যে পান্ডিত্যের পরিবর্তে উত্তেজিত এবং সহিংসপূর্ণ কার্যক্রম পরিলক্ষিত হয়। আবার অনেক যায়গায় "মোল্লা" শব্দ দ্বারা সম্মানীয় বংশ বা টাইটেল হিসাবেও ব্যবহৃত হয়েছে, যেমন "মোল্লা ওমর" "কাদের মোল্লা" ইত্যাদি। ভারতীয় উপমহাদেশে ‘মৌলভী’ এবং ‘মাওলানা’ শব্দটি একে অপরের ক্ষেত্রে অদলবদল করে ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
আল-কুর’আনের দ্বিতীয় সূরা আল-বাক্বারা’র শেষের আয়াতে ‘মাওলানা’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে, যে আয়াতটি প্রায়শই দু’আ-মুনাজাতে পাঠ করতে শোনা যায়। আল্লাহ্ বলেনঃ “আন্তা মাওলানা ফানসুরনা ‘আলাল কাওমিল কাফিরিন।” অর্থাৎ “তুমিই আমাদের প্রভু। সুতরাং কাফের সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে আমাদেরকে সাহায্য কর।” (সূরা বাকারা, আয়াতঃ ২৮৬) কেউ কেউ এই আয়াতটি ব্যবহার করে বোঝাতে চান, যেই শব্দটি আল্লাহ’র ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়েছে তা মানুষের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা মানে হলো- তাকে আল্লাহ’র পর্যায়ে উত্তীর্ণ করে ফেলা। [এটি সঠিক নয়]
আল-কুর’আনের দ্বিতীয় সূরা আল-বাক্বারা’র শেষের আয়াতে ‘মাওলানা’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে, যে আয়াতটি প্রায়শই দু’আ-মুনাজাতে পাঠ করতে শোনা যায়। আল্লাহ্ বলেনঃ “আন্তা মাওলানা ফানসুরনা ‘আলাল কাওমিল কাফিরিন।” অর্থাৎ “তুমিই আমাদের প্রভু। সুতরাং কাফের সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে আমাদেরকে সাহায্য কর।” (সূরা বাকারা, আয়াতঃ ২৮৬) কেউ কেউ এই আয়াতটি ব্যবহার করে বোঝাতে চান, যেই শব্দটি আল্লাহ’র ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়েছে তা মানুষের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা মানে হলো- তাকে আল্লাহ’র পর্যায়ে উত্তীর্ণ করে ফেলা। [এটি সঠিক নয়]
আবার কারো কারো যুক্তি হলো- আল-কুর’আনের বারো নম্বর সূরা ইউসুফ-এর ২৩ নম্বর আয়াতে হযরত ইউসুফ (আঃ) তার আশ্রয়দাতা হিসেবে আজিজ মিশরীকে ‘ইন্নাহু রাব্বি’ অর্থাৎ ('he is my lord') ‘সে আমার মালিক’ সম্বোধন করেছেন। আজিজ মিশরীর স্ত্রী যখন হযরত ইউসুফ (আঃ)-কে কাছে ডাকল/কু-প্রস্তাব দিলো, তখন তিনি বললেনঃ “ক্বলা মা’আযাল্লাহি ইন্নাহু রব্বি আহ্সানা মাশওয়া ইয়া” অর্থাৎ “সে বললঃ আল্লাহ্ রক্ষা করুন; তোমার স্বামী আমার মালিক; তিনি আমাকে সযত্নে থাকতে দিয়েছেন।” অবশ্যই এখানে হযরত ইউসুফ (আঃ) আল্লাহর সাথে আজিজ মিশরীকে সমকক্ষ নির্ধারণ করে বলেননি। ঠিক একই দৃষ্টিকোন থেকে ‘মাওলানা’ শব্দটিও স্রষ্টার জন্য খাস কোনো শব্দ নয় কিংবা এটা স্রষ্টার কোনো নামও নয়।
কোরআনে আল্লাহ্ তা’আলা নিজের পাশপাশি ফেরেশতা জিবরাঈল (আ.) এবং মু’মিন-মুত্তাকি বান্দাদের ক্ষেত্রেও ‘মাওলা’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। আল-কোরআনে ৬৬ নম্বর সূরা আত-তাহরীমের ৪ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেনঃ “ইন তাতুবা ইলাল্লাহি ফাক্বাদ ছোয়াগাত ক্বুলুবুকুম; ওয়া ইনতা যোহারা আলাইহি ফা ইন্নাল্লাহা হুয়া ‘মাওলাহু’ ওয়া জিবরিলু ওয়া সোলিহুল মু’মিনীন; ওয়াল মালাইকাতু বা’দা যালিকা যোহিরুন।” অর্থাৎ “তোমাদের অন্তর অন্যায়ের দিকে ঝুঁকে পড়েছে বলে যদি তোমরা উভয়ে তওবা কর, তবে ভাল কথা। আর যদি নবীর বিরুদ্ধে একে অপরকে সাহায্য কর, তবে জেনে রেখ আল্লাহ্, জিবরিল এবং সৎকর্মপরায়ন মুমিনগণ তাঁর সহায়। উপরন্তু ফেরেশতাগণও তাঁর সাহায্যকারী।” (সূরা আত-তাহরীম, আয়াতঃ ৪)। এখানে ‘মাওলা’ শব্দটি ‘সহায়’ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।
সুতরাং মাওলানা শব্দটির অর্থ, ব্যবহারের উপর নির্ভর করে করতে হবে। যখন আল্লাহ পাকের ক্ষেত্রে প্রয়োগ হবে তখন সৃষ্টিকর্তা মালিক, একমাত্র সাহায্যকারী (ইইয়্যাকা নাসতাঈন) যাঁর কাছে সাহায্য চাই, তিনিই আল্লাহ বুঝায়। যখন অন্য কারো ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হবে তখন সেটি আমাদের অভিভাবক, সাহায্যকারী, নেতা এই অর্থেই বুঝা যাবে। তবে একজন মানুষ শুধু মাদ্রাসায় পড়লেই এই উপাধি পাবেন অন্য কেহ পাবেনা এটি অযৌক্তিক।
যিনিই এই পর্যায়ের হবেন তিনিই মূলত এক উপাধির উপযুক্ত। তবে সাধারণত যাঁরা ইসলামিক জ্ঞ্যান অর্জন করে দ্বীনের প্রচারক বা দ্বীনি শিক্ষকতা করার সামর্থ রাখেন তাদেরকেই মাওলানা হিসাবে অভিহিত করার প্রচলন হয়ে গেছে। কিন্ত একজন চেয়ারম্যান বা এম, পি, কে জনগণ তাদের প্রতিনিধি হিসাবে তাদের সাহায্যকারী, বা নেতা নির্বাচিত করল ঠিকই কিন্তু উনাকে মাওলানা কখনোই বলা যায়না, যদি বলা হয় তাহলে নিতান্তই হাস্যকর, অযৌক্তিক মনে হবে।
ঠিক তেমনি ভাবে যখন কোন কেহ নিজের নামের আগে নিজেই মাওলানা লিখবেন তাও শোভা পাবেনা।
কারন নিজেকে নিজেই কি "আমাদের অভিভাবক, সাহায্যকারী বলা যায়? আশা করি মাওলানা শব্দের অর্থ ও ব্যবহার জেনেছেন।
COMMENTS